NT 60K185
উদ্যোক্তা হওয়া মানে শুধুমাত্র ব্যবসা শুরু করা নয়, বরং একটি দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেওয়া। প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই ব্যবসার জগতে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন একটি দৃঢ় মানসিকতা, যে মানসিকতা বাধা ও ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে শেখায়। আপনি যত টাকাই বিনিয়োগ করুন, যদি আপনার মানসিক প্রস্তুতি না থাকে—তাহলে সেই ব্যবসা অনেকটা বালির উপর তৈরি ভবনের মতো হবে, যা সামান্য ঝড়েই ধসে পড়বে।
এই ব্লগে আমরা বিশদভাবে জানবো কীভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা তৈরি করা যায় এবং একজন সফল ব্যবসায়ীর মতো মানসিক গুণাবলি কীভাবে গড়ে তুলবেন।
উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
উদ্যোক্তা মানসিকতা বলতে এমন একটি মানসিক গঠন বোঝায় যা সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী, অজানাকে মেনে নেওয়ার সাহসী এবং ব্যর্থতাকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখে। এই মনোভাব ছাড়া ব্যবসার প্রতিটি ধাপে আপনি নিজেকে দোটানার মধ্যে পড়ে যেতে পারেন। কারণ ব্যবসা মানেই হল অনিশ্চয়তার মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।
উদাহরণস্বরূপ, বাগেরহাটের শামসুল হক ২০২০ সালে একটি পোল্ট্রি খামার শুরু করেন। প্রথম বছরেই লোকসানের মুখে পড়েন। কিন্তু তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন বলেই হাল না ছেড়ে ২০২২ সালে আবার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে ফিরে আসেন এবং এবার লাভ করতে সক্ষম হন। এই উদাহরণ প্রমাণ করে—উদ্যোক্তা মানসিকতা ছাড়া শুধুমাত্র মূলধনের ওপর নির্ভর করে সফল হওয়া যায় না।
ব্যবসা শুরু করার প্রস্তুতি কিভাবে নেবেন? স্টেপ বাই স্টেপ গাইড
১. আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলুন – সফল উদ্যোক্তার মূল ভিত্তি
আত্মবিশ্বাস ছাড়া আপনি ব্যবসার ঝুঁকি নিতে পারবেন না। ব্যবসা চলাকালীন সময়ে প্রতিনিয়ত আপনাকে ছোট-বড় নানা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যেগুলো ভবিষ্যতে লাভ অথবা ক্ষতির কারণ হতে পারে। যদি আপনার নিজের সিদ্ধান্তে আস্থা না থাকে, তাহলে আপনি দোটানা আর অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে যাবেন।
কীভাবে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলবেন:
-
দৈনন্দিন জীবনে ছোট সিদ্ধান্তগুলো নিজে নিন।
-
ভুল হলে সেটাকে ব্যর্থতা হিসেবে নয়, শেখার সুযোগ হিসেবে নিন।
-
সফল উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা পড়ুন এবং তাদের বক্তব্য শুনুন।
বাস্তব উদাহরণ: Pathao-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন ইলিয়াসের কথায়, “প্রথমে যখন শুরু করেছিলাম, সবাই বলেছিল বাংলাদেশে এই সিস্টেম চলবে না।” কিন্তু তার আত্মবিশ্বাসই তাকে এবং তার টিমকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে গেছে।
২. ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা – উদ্যোক্তা হওয়ার অন্যতম শর্ত
ঝুঁকি গ্রহণ না করলে উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। কারণ প্রতিটি ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের পেছনে থাকে অনিশ্চয়তা—এটি সফলও হতে পারে, আবার ব্যর্থও হতে পারে। ঝুঁকি মানে কেবল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নয়; এটি সময়, মানসিক শক্তি, সামাজিক প্রতিচ্ছবি ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রভাব ফেলে।
একজন উদ্যোক্তা যদি চাকরি ছেড়ে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন, তাহলে সেটি একটি বড় ঝুঁকি। একইভাবে, যদি আপনি নতুন কোনো বাজারে প্রবেশ করেন যেখানে আগে কেউ কিছু বিক্রি করেনি, সেটিও ঝুঁকি। কিন্তু পরিকল্পিত ঝুঁকি নেওয়াই সফল উদ্যোক্তার গুণ।
উদাহরণ: একজন তরুণ নারী উদ্যোক্তা ঢাকার বাইরে বিউটি প্রোডাক্ট নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে কেউ বিশ্বাস করেনি তিনি সফল হবেন। কিন্তু মার্কেট রিসার্চ, টার্গেট কাস্টমার স্টাডি ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি এলাকায় নিজের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেন।
ঝুঁকি নেওয়া মানেই হঠকারিতা নয়। বরং এটি হতে হবে তথ্যভিত্তিক, গবেষণাপ্রসূত এবং পরিকল্পনামাফিক।
৩. ধৈর্য ও পরিশ্রম – ব্যবসা শুরু করার সময়ের চাবিকাঠি
অনেকেই ভাবেন, ব্যবসা শুরু করলেই এক-দুই মাসের মধ্যে লাভ আসবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রথম ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে বেশিরভাগ ব্যবসা লোকসানের মুখে পড়ে। এই সময়টিতে ধৈর্য না রাখলে অনেকেই হাল ছেড়ে দেন।
সফল উদ্যোক্তারা জানেন—ব্যবসা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। তারা প্রতিদিন নিরবিচারে পরিশ্রম করেন, কারণ জানেন যে তাদের প্রচেষ্টা একদিন সফলতা এনে দেবে।
বাস্তব উদাহরণ: চট্টগ্রামের ইফতেখার ভাই প্রথম ৮ মাসে অনলাইনে কাপড় বিক্রি করে মাত্র ৩৫টি অর্ডার পান। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। আজ তিনি প্রতিমাসে ৭০-৮০ হাজার টাকা আয় করেন।
সফল উদ্যোক্তার গুণাবলি (Top 10 Entrepreneurial Qualities)
৪. লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিকল্পনা করার দক্ষতা
একজন সফল উদ্যোক্তা জানেন তিনি কোথায় যেতে চান এবং কীভাবে সেখানে পৌঁছাতে হবে। তাই ব্যবসার শুরুতেই একটি পরিষ্কার ভিশন ও রোডম্যাপ তৈরি করা জরুরি।
লক্ষ্যহীনভাবে ব্যবসা চালালে সেটি গন্তব্যহীন জাহাজের মতো দিক হারাবে।
৫. সময় ব্যবস্থাপনা ও প্রোডাকটিভ হ্যাবিট
আপনার সময়ই আপনার মূলধন। সফল উদ্যোক্তারা প্রতি মিনিটকে মূল্য দেন। তারা ডেইলি টাস্ক লিস্ট তৈরি করেন, “Pomodoro Technique” বা “Time Blocking” পদ্ধতি ব্যবহার করে নিজেদের কাজকে সুশৃঙ্খল রাখেন।
পরিকল্পিত সময় ব্যবস্থাপনাই একজন উদ্যোক্তার দিনকে গঠনমূলক করে তোলে।
৬. শেখার আগ্রহ ও নমনীয়তা
মার্কেট প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে। একজন সফল উদ্যোক্তা শুধু নিজের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেন না, বরং তিনি নতুন কিছু শিখতে সদা প্রস্তুত থাকেন।
উদাহরণ: যারা কোভিড পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল মার্কেটিং শিখে নিজেদের ব্যবসাকে অনলাইনে স্থানান্তর করেছেন, তারা টিকে থাকতে পেরেছেন।
৭. ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষমতা
ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়, বরং এটি একটি নতুন শুরুর নাম। সফল উদ্যোক্তা জানেন—ব্যর্থতা একটা অভিজ্ঞতা। তিনি ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ঠিক করেন।
উদাহরণ: Elon Musk-এর প্রথম তিনটি স্পেস মিশন ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু তিনি থামেননি। চতুর্থবারেই সফল হন এবং SpaceX আজ বিশ্বের শীর্ষ স্পেস কোম্পানিগুলোর একটি।
টিম তৈরি ও লিডারশিপ – ব্যবসা বাড়াতে যেটা সবচেয়ে জরুরি
৮. টিম বিল্ডিং ও নেতৃত্বের গুণাবলি
একজন উদ্যোক্তার একার পক্ষে ব্যবসা বড় করা সম্ভব নয়। তাকে একটি দক্ষ টিম তৈরি করতে হবে এবং সেই টিমকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে। নেতৃত্ব মানে আদেশ নয়, বরং উদাহরণ দিয়ে পথ দেখানো।
সফল উদ্যোক্তা তার টিমকে অনুপ্রাণিত করেন, সমালোচনা নয়—উৎসাহ দিয়ে সমস্যা সমাধান করেন।
৯. গ্রাহক বোঝার ক্ষমতা
আপনার পণ্য যত ভালোই হোক, যদি গ্রাহকের চাহিদা না বোঝেন, তাহলে সেটি বিক্রি হবে না। উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় গুণ হলো তার টার্গেট কাস্টমারকে বুঝে পণ্য বা সার্ভিস ডিজাইন করা।
গ্রাহকের রিভিউ, সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্টস এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করুন।
নতুন উদ্যোক্তার জন্য করণীয়: সফল ব্যবসা গড়ার প্রাথমিক ধাপ
১০. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার – ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ওয়েবসাইট
বর্তমান সময়ে ডিজিটাল মাধ্যম ছাড়া ব্যবসা কল্পনাও করা যায় না। একটি ফেসবুক পেজ, একটি সুন্দর ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল, আর যদি সম্ভব হয় একটি ওয়েবসাইট—এই তিনটি থাকলেই আপনি যে কোনো প্রান্তিক এলাকা থেকেও ব্যবসা শুরু করতে পারবেন।
আজকাল বাংলাদেশের গ্রামের তরুণরাও ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করছে শুধুমাত্র স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
উপসংহার: উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া বিজনেস শুরু নয়
উদ্যোক্তা হওয়ার মানে নিজেকে বারবার গড়ে তোলা, শিখতে থাকা এবং পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। শুধুমাত্র পুঁজি ও আইডিয়া যথেষ্ট নয়—যদি আপনার মন প্রস্তুত না থাকে, তবে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন।
সুতরাং, আপনি যদি সফল হতে চান, তাহলে শুরুতেই নিজের মানসিক প্রস্তুতি নিন। আত্মবিশ্বাস, ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা, ধৈর্য ও শেখার আগ্রহ—এই গুণগুলো থাকলে আপনি শুধু ব্যবসা গড়ে তুলতে পারবেন না, বরং অন্যদের অনুপ্রেরণার উৎস হবেন।