মুখস্থ নয়, জ্ঞান অর্জনই হোক মুখ্য বিষয়
আমরা যখন এসএসসি পরীক্ষা দিতাম, তখন বিভিন্ন বই থেকে নোট করে লিখতাম। তাও ১০–এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬ পেতাম। আর এখন নোট না করে পরীক্ষায় ১০–এ ৮ পায় গণহারে। এসব বিষয় দেখার সময় চলে আসছে। সংখ্যা বেড়েছে যথেষ্ট। এখন সময় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মানের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার দিকে লক্ষ করলেও ব্যাপারটি বোঝা যায়।
ভর্তি পরীক্ষায় বিভিন্ন শর্ত ছিল, শর্ত থাকাটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে বিজ্ঞান অনুষদের ক ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ)। খ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী উত্তীর্ণের হার ৯ দশমিক ৮৭ (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ)। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের গ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ)। ঘ ইউনিটে (সমন্বিত বিভাগ) উত্তীর্ণ হয়েছেন ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ)। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ক ইউনিট থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন ৩ জন, ৯৫ করে। খ ইউনিটে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৭৬ দশমিক ৫০। গ ইউনিটে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৯৬ দশমিক ৭৫। ঘ ইউনিটে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর যথাক্রমে ৮৩ দশমিক ৯৫, ৮৪ ও ৭৩ দশমিক ১০। জিপিএ–৫ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করছেন না শিক্ষার্থীরা। এটা নিয়ে আলোচনা চলমান। যদিও অনেকেই মনে করেন, পরীক্ষাপদ্ধতির কারণে পাসের হার কমছে। কিন্তু আমার মতে এটা সঠিক তথ্য নয়। কারণ, তা–ই যদি হতো, তাহলে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৮৪ বা ৭৬ হতো না। যাঁরা মেধাবী এবং গুণগত মানে উত্তীর্ণ হয়ে যেসব শিক্ষার্থী জিপিএ–৫ পেয়েছেন, তাঁরা ঠিকই ভর্তি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
এ বছর সবচেয়ে শোচনীয় ফলাফল হয়েছে মানবিক অনুষদের অধীন খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায়। এ অনুষদে পাস করেছেন মাত্র ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকি ৯০ দশমিক ৪৫ শতাংশই অবৃতকার্য হয়েছেন, যা খুবই দুঃখজনক। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সর্বোচ্চ ফল করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তাঁরা কেন পাস নম্বর পান না, তা আমার বোধগম্য নয়। কম শিক্ষার্থী পাস করায় এবং বিভিন্ন শর্ত থাকায় অনেক বিভাগে আসন খালি রেখে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে হয়, যা সরকারে টাকার অপচয়। একইসংখ্যক শিক্ষক বা শ্রেণিকক্ষ নিয়ে যদি বেশি শিক্ষার্থীকে পড়ানো যায়, সেটা তো বেশি যৌক্তিক।
যাঁরা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন, সনদে তাঁদের ফল অনেক ভালো। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা শুধু মুখস্থবিদ্যায় বেশি গুরুত্ব দেন বলে মনে হচ্ছে। শিক্ষক ও অভিভাবকদের গুরুত্ব দেওয়ার সময় এখনই, যাতে আমাদের ছেলেমেয়েরা সৃজনশীল মেধায় গড়ে উঠতে পারে।
প্রাথমিকসহ সব ক্ষেত্রে ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন খুবই কম। তাঁদের বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সব পর্যায়ের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে স্কেল বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন ছাড়া কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না। উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে প্রথমে শিক্ষার মানের বিষয়ে নজর দিতে হবে। যদিও সরকার চেষ্টা করছে; তারপরও কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, সেগুলো বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরা সবাই সনদমুখী। এ কথা অস্বীকার করতে পারছি না। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শিক্ষায় জ্ঞান অর্জনকে মুখ্য বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে হবে। চাকরি বা সনদ অর্জনের জন্য যে শিক্ষা, তা আসলে প্রকৃত শিক্ষা নয়। আর এ কারণে সমাজে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে। আমি মনে করি, সব ক্লাসে, অর্থাৎ প্রথম শ্রেণি থেকে সর্বোচ্চ শ্রেণি পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষার বিষয় থাকা দরকার। আজ সমাজে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ছিনতাই ও লুটপাট বেড়েই চলছে। কারণ, ছেলেমেয়েরা নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে না। নৈতিক শিক্ষার জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
মুখস্থনির্ভর শিক্ষার যে ধারা আজ আমাদের দেশে বিপর্যয় ডেকে আনছে, তা এখনো থেমে থাকেনি; বরং আরও বেড়ে চলছে। বিসিএস পরীক্ষা অনেকটা মুখস্থনির্ভর বলে কথা রয়েছে। এখন বর্তমান শিক্ষার্থীরা অনেকেই বিসিএসমুখী। শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেওয়ার সময় বিসিএস গাইড পড়তে দেখা যায়। এ পেশা বেশি লোভনীয় বর্তমানে। তাই বিসিএস পরীক্ষায় প্রশ্নপদ্ধতি ও পরীক্ষার ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা জরুরি, কারণ গতানুগতিক পড়াশোনা করে যাতে কেউ বিসিএস ক্যাডার না হতে পারেন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে এ বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে মুখস্থনির্ভর বিসিএস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়।
করোনার সময়ে শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতি রয়েছে, সেই শিখনঘাটতি কাঠিয়ে উঠতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন পাঠ্যসূচির সমন্বয় করা। শিক্ষকদের এ বার্তা দেওয়া জরুরি যে শ্রেণিকক্ষে শিশুদের অংশগ্রহণে সক্ষম করে তুলতে হবে।
দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের ওপর বড় প্রভাব পড়েছে। বাল্যবিবাহের হার বেড়ে গেছে। তাই এ বিষয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে—কীভাবে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা যায়। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।
তাদেরও স্কুলে ফেরত আনতে হবে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের বোঝাতে হবে, যাতে তাঁরা অনুপ্রেরণা পান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের পাঠাতে। এ ক্ষেত্রে মানুষ যাতে সাড়া দেয় এবং বিশেষ করে কন্যাশিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, কন্যাশিশুরা বেশি ঝরে পড়েছে পড়াশোনা থেকে। মূলত, ভালো গ্রেড অর্জনকে গুরুত্ব না দিয়ে শ্রেণিশিক্ষা কার্যক্রমে আমাদের শিক্ষক, অভিভাবক ও সরকারকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
সূত্রঃ প্রথম আলো