এক জাতি অপর জাতি থেকে বেশি মেধাবী, এমন দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত?

এক জাতি অপর জাতি থেকে বেশি মেধাবী, এমন দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত?

SA-23K 612

‘মাধ্যমিক শিক্ষায় “মহা-উন্নয়ন” এবং করোনার আশীর্বাদ-গীতি’ শিরোনামে ৩০ আগস্ট ২০২২ তারিখে জনাব আবদুস সাত্তার মোল্লার একটি লেখা দৈনিক প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। এ লেখায় লেখক মূলত ২৯ জুলাই ২০২২ তারিখে একই পত্রিকায় প্রকাশিত ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের ‘শিক্ষায় যেখানে আমরা অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে’ শিরোনামে লেখার দুর্বলতাগুলো তুলে ধরেছেন।

এটা ঠিক যে বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সত্যিকার অর্থে উল্লেখ করার মতো বিশেষ উন্নয়ন হয়েছে, এমন দাবি করা কষ্টকর। কেননা, ইংরেজ শাসনকালে এ দেশে যে কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন লর্ড ম্যাকলে, তা থেকে বেরিয়ে এসে এ জাতির স্বকীয়তা ও নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে একটি শিক্ষাব্যবস্থা এখনো দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক কিছু যোগ-বিয়োগ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু এর বেশির ভাগ সংস্কার কার্যক্রম ধার করা। মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ধারণাগুলো আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবায়ন করার চেষ্টা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু বারবারই আমরা কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছি। উদাহরণ হিসেবে মূল্যায়নব্যবস্থায় কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন প্রবর্তন, যা আমাদের এখানে সৃজনশীল নামে অধিক পরিচিত বিষয়টির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে

কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রে শিখন মূল্যায়ন একটি উন্নত মূল্যায়নব্যবস্থা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের দেশে এটা যথাযথ কাজ করেনি। কেন করেনি, সে বিষয়ে আলোচ্য এ নিবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। মূলত এ লেখার সূত্রপাত জনাব সাত্তার সাহেব তাঁর লেখায় কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। প্রথমত, তিনি তাঁর লেখায় বাংলাদেশ শিক্ষায় কোন কোন দেশের তুলনায় কতটা উন্নতি করেছে, তা উপলব্ধি করার জন্য উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা কারা, এ জাতির সম্ভাবনা কেমন, এর কাছে প্রত্যাশাই-বা কীরূপ।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো দেশের শিক্ষায় উন্নতি করার সঙ্গে তারা কারা এবং তাদের সম্ভাবনা কেমন, বিষয়টি কি আদৌ কোনো ভূমিকা রাখে? যেখানে বাংলায় একটি কথা আছে, ‘জন্ম হোক যথা-তথা, কর্ম হোক ভালো’। আমি বা আমরা কী, আমার সম্ভাবনা কেমন, এগুলো কোনোই কাজে আসবে না, যদি আমি আমার কাজটা যথাযথভাবে না করি। এ কথা শুধু বাঙালি জাতি নয়, বিশ্বে অপরাপর জাতির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বংশপরম্পরা কিংবা ইতিহাস-ঐতিহ্য—কোনো কিছুই কাজে আসবে না, যদি তারা তাদের উন্নয়নের জন্য সঠিক কাজটি না করে।

সাত্তার সাহেব আরও বলেছেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা যথেষ্ট মেধাবী এবং ভারতীয় উপমহাদেশে অনেকের চেয়ে মেধায় এগিয়ে।’ একটি দেশ কিংবা জাতি অপর কোনো জাতি বা দেশ থেকে মেধাবী, এমন দাবি কি করা যায়? এ ধরনের কথার ভিত্তি কী? ‘মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশ শিক্ষায় ভালো করছে’, ড. ফারুকের এমন মন্তব্যের বিপরীতে তিনি যে যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা যুক্তিযুক্ত নয় বলে মনে করি। বিশেষ করে যে দেশের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে তো বটেই। মালয়েশিয়া সম্পর্কে তিনি বলে, ‘দেশটির প্রধান (প্রায় ৬০ শতাংশ) জাতিগোষ্ঠী মালের মেধা কেমন, কী অবস্থা এর ভাষা-কৃষ্টি ও শিক্ষার? ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে মালে চায়নিজ তো বটে, তামিলদের চেয়েও কম মেধাবী।’ এখন প্রশ্ন হলো, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কি কখনো কেনো দেশ দাবি করতে পারে যে আমরা এই দেশ ওই দেশ থেকে বেশি মেধাবী?

প্রথমত, এ ধরনের দাবি করা অযৌক্তিক। ভৌগোলিক অবস্থান, ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মবিশ্বাসে ভিন্নতা থাকলেও বিশ্বের মানুষ এখন একটি বৃহত্তর গ্রামের অধিবাসী। এখানে কেউ কারও উদ্দেশে এমন কথা বলার আগে চিন্তা করা প্রয়োজন। আমার ধারণা, জনাব সাত্তার সাহেব বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি বলেই মালয়েশিয়ার মালে জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় বাঙালিরা মেধাবী, এমন অবৈজ্ঞানিক কথা বলেছেন। আবার বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের আলোকেও বিশ্বে কেউ বেশি মেধাবী আর কেউ কম মেধাবী, এই দাবিও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, প্রত্যেক মানবশিশু জন্মগ্রহণ করে সমান সম্ভাবনা নিয়ে। এখানে সুস্থ মা ও সুস্থ শিশুর কথা বলা হচ্ছে।

মূলত শিশুর বিকাশ বা তার মেধাবিকাশের কার্যক্রম শুরু হয় শিশু মায়ের পেটে থাকার সময় থেকে। মায়ের স্বাস্থ্য, পরিবেশ, শিশুর যত্ন, খাবার এবং সামগ্রিক অর্থে সুযোগ-সুবিধার ওপর নির্ভর করে শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ। পরিবেশ-পরিস্থিতি, যত্ন ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে শিশুতে শিশুতে বৈষম্য তৈরি হয়। কেউ এগিয়ে যায় আর কেউ পিছিয়ে পড়ে। দায় মূলত সমাজের, রাষ্ট্রের এবং পরিবারের। মনুষ্যসৃষ্ট বৈষম্যের কারণে মেধাবিকাশের ক্ষেত্রে যে পার্থক্য তৈরি হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে কি আমরা বলতে পারি, ওদের তুলনায় আমরা মেধাবী জাতি? জনাব সাত্তার সাহেব তাঁর লেখায় আরও যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন, বাংলাদেশের শিক্ষায় উন্নতি করার পেছনে সেগুলো আমলযোগ্য নয়। যেমন, তিনি নিজস্ব বর্ণমালার থাকা না থাকার কথা বলেছেন, তিনি ভাষা নিয়ে সংগ্রাম করার কথা বলেছেন, কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হিসেবে এর বাইরের দেশের থেকে বাংলাদেশের শিক্ষায় উন্নতি করার কথা বলেছেন। এগুলোর কোনোটিই একটি দেশের শিক্ষায় উন্নতি কিংবা অবনতির নিয়ামক হতে পারে না। শিক্ষায় উন্নতি করতে হলে সেই দেশকে সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে এবং পরিকল্পনামতো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তবেই সেই দেশ শিক্ষায় উন্নতি করতে সক্ষম হবে

জনাব সাত্তারের মালয়েশিয়ার মালে জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা না থাকার কারণে তারা আমাদের তুলনায় কম মেধাবী, এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শুধু একটি কথা দিয়ে এ লেখা শেষ করব। তাঁর নিশ্চয়ই জানা আছে যে আজ যে ভাষা বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে, সেই ইংরেজি ভাষারও কিন্তু নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তাহলে কি ইংরেজি যাদের মাতৃভাষা, তারাও কম মেধাবী বাঙালিদের

   সূএ :  প্রথম আলো     

Leave a Comment