জার্মানিতে বিনামূল্যে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য আবেদন করবেন যেভাবে

জার্মানিতে বিনামূল্যে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য আবেদন করবেন যেভাবে

NT-21K 459

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি গত কয়েক বছর ধরে সফলতার সঙ্গে পড়াশোনা করছেন জার্মানিতে 

গবেষণা নির্ভর বিদ্যাপীঠের জন্মস্থান জার্মানি জ্ঞানের এক সমৃদ্ধশালী বিশ্বকোষ। ইউরোপীয়ান দেশটির ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের জায়গা ধরে রেখেছে কিউএস (কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস) র‍্যাঙ্কিং-এ। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো- বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কোনো অর্থই খরচ করতে হয় না। দেশটির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পনেরশটিরও বেশি বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ দিয়ে আসছে। এগুলোর মধ্যে প্রকৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা, এবং সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের মতো অধিক চাহিদা সম্পন্ন কোর্সগুলোই প্রধান, যেখানে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা হয়। 

জার্মানিতে বিনামূল্যে স্নাতকোত্তরের জন্য পর্যায়ক্রমিক আবেদন পদ্ধতি

প্রথম ধাপ: জার্মানিতে স্নাতকোত্তর নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞানার্জন ও পরিকল্পনা

আবেদন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য অনেক আগে থেকেই মাস্টার্স ও পিএইচডির ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আর এই তথ্যগুলোই তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা তৈরিতে সহায়তা করবে। প্রথমেই নিশ্চিত হতে হবে, শিক্ষার্থীর স্নাতক করা বিষয়টির উপর স্নাতকোত্তর করার সুযোগ জার্মানির বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিচ্ছে কিনা। খুব সহজে নিজের পছন্দের বিষয়টি খুঁজে নেওয়ার জন্য কমুনিটি ওয়েবসাইট ডাড-এর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। বিনাখরচে পড়ার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়টির শহরের প্রতিও নজর দেওয়া উচিত। স্বাভাবিক ভাবেই উন্নত শহরে চাকরির ব্যবস্থা সহজসাধ্য হয়ে থাকে। 

কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে রেস্ট্রিক্টেড ক্যাটাগরির কিছু কোর্স থাকে, যেগুলোতে ভর্তির আসন সংখ্যা থাকে সীমিত। এখানে সবচেয়ে সেরা প্রার্থীদের ভেতর থেকেই বাছাই করা হয়ে থাকে। আর কিছু থাকে নন-রেস্ট্রিক্টেড প্রোগ্রাম। এখানে তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখিত আবেদনের নূন্যতম যোগ্যতা পূরণ করলেই অফার-লেটার পাওয়া যায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ও কোর্স নির্বাচনের সময় এই রেস্ট্রিক্টেড ও নন-রেস্ট্রিক্টেড বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

তারপরেই আসছে খরচেই বিষয়টি। পড়াশোনার খরচ না থাকলেও একজন শিক্ষার্থী জার্মানিতে যেয়ে পড়াশোনার সময় প্রথম বছর তার থাকা-খাওয়ার খরচ চালাতে পারবে কিনা তার জন্য সিকিউরিটি মানির ব্যবস্থা করতে হয়। এই অঙ্কটি এখন পর্যন্ত ১০,৩৩২ ইউরো বা প্রায় ১০ লক্ষ টাকার কাছাকাছি হলেও, সামনের উইন্টার সেশন অর্থাৎ ২০২৩-এর শিক্ষার্থীদের জন্য ১১,১৭২ ইউরো বা ১০ লক্ষ ৬৭ হাজার ৬৬ টাকা হতে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পাবার পর ভিসা হওয়ার আগে জার্মানিতে নির্দিষ্ট ব্যাংকে এই টাকাটা পাঠিয়ে দিতে হয়। খুব কম সময়ের মধ্যে এতগুলো টাকা একসাথে ব্যবস্থা করা খুব কঠিন ব্যাপার। তাই মনস্থির করার পর পরই এই টাকা ব্যবস্থা করার চেষ্টা শুরু করতে হবে। 

শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশ থেকেই জার্মানির নির্দিষ্ট ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকাটা পাঠাতে হয়, যেটা শিক্ষার্থীর নামেই ব্লক্ড অ্যাকাউন্ট হিসেবে জমা থাকে। শিক্ষার্থীকে জার্মানিতে যাওয়ার পর প্রতি মাসে ৮৬১ ইউরো করে এক বছরে পুরো টাকাটা তুলতে পারবে। পূর্ব পরিকল্পনার সময় এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন ও খরচের বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নিতে হবে। 

জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত প্রতিবছরে ২টি সেশনে ভর্তির জন্য আবেদন করা যায়। একটি সামার সেশন; যেখানে আবেদনের সময়সীমা থাকে ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারী পর্যন্ত। দ্বিতীয়টি হলো উইন্টার, এবং এখানে আবেদন করতে ১ মে থেকে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আবেদনের ক্রিয়াকলাপ শুরু করার সময় এই সময়সীমার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।

দ্বিতীয় ধাপ: আইইএলটিএস সহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য টেস্ট

জার্মানিতে প্রায় সব স্নাতকোত্তর কোর্সই স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় পড়ানো হয়। জার্মানি ভাষা শেখাটাতে স্বাভাবিক ভাবেই পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট টাইম জবে সুবিধা পাওয়া যায়। তবে ইংরেজি বলতে পারা লোকদের জন্যও জার্মানি বেশ সাবলীল। তাই নূন্যতম ৬.৫ আইইএলটিএস স্কোর যথেষ্ট জার্মানির শিক্ষা ব্যবস্থা ও জীবনধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য। তবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ের ওপর নির্ভর করে জিআরই বা জিম্যাটও চাইতে পারে। এর জন্য আগেই বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে চাহিদাগুলো জেনে নিতে হবে।

তৃতীয় ধাপ: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যোগাড়

→ (অনার্স, বিএসসি, বিবিএ, বিএ) স্নাতক সহ বিগত সকল একাডেমিক ডিগ্রীর সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট

(স্টাডি গ্যাপ সর্বোচ্চ ৪ বছরের বেশি গ্রহণযোগ্য নয়)

→ যারা এখনও গ্রেডিং সিস্টেমের আওতাভুক্ত হননি তাদের জন্য মিনিমাম পাসিং গ্রেড সংযুক্ত করতে হবে

→ পাসপোর্ট

→ আইইএলটিএস সনদ

→ স্টাডি প্ল্যান সহ মোটিভেশন লেটার

→ ২টি রিকমেন্ডেশন লেটার (যে বিষয়ে জার্মানিতে পড়তে যাওয়া হচ্ছে সে বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীর নিজের স্নাতক করা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের নিকট থেকে ১টি, আর আরেকটি ব্যাচেলর করা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের ডিনের কাছ থেকে)

→ জার্মানির ব্যাঙ্কে ব্লক্ড অ্যাকাউন্টের নথি

→ ইউরো পাস সিভি

এছাড়াও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও কিছু কাগজপত্র দরকার হতে পারে। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইট ভালো করে অধ্যয়ন করে নিতে হবে। সকল কাগজপত্র যোগাড় করে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, শিক্ষা বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রনালয়, এবং ঢাকার জার্মান এম্ব্যাসি থেকে সত্যায়ন করতে হবে। অথবা বিকল্প হিসেবে নোটারি করা যেতে পারে।

চতুর্থ ধাপ: আবেদন পদ্ধতি

জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার আবেদনের জন্য সবচেয়ে সহজ ও বিনাখরচের মাধ্যম হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্ব স্ব ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন করা। এর জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আগে থেকেই স্ক্যান করে রাখতে হবে। তবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হার্ড কপি চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে ফেডেক্স বা ডিএইচএলের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় কুরিয়ার করতে হবে। এখানে কিছু খরচ করতে হবে। এছাড়াও ইউনি অ্যাসিস্টের মাধ্যমেও জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করা যায়। এক্ষেত্রে ইউনি অ্যাসিস্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন করতে হবে। এখানে আবেদনপত্রসহ সত্যায়িত বা নোটারী করা কাগজগুলোর এক সেট ইউনি অ্যাসিস্টের এর ঠিকানায় ডিএইচএল বা ফেডেক্স দিয়ে পাঠাতে হয়। এখানে বেশ ভালো পরিমাণ খরচ হয়ে যায়।

একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের ক্ষেত্রে যেটার ডেডলাইন খুব কাছাকাছি, স্বাভাবিকভাবেই সেটাতে আগে আবেদন করতে হবে। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের ইন্টারফেস এক রকম নয়। কিন্তু যে তথ্যগুলো প্রদান করতে হয় তা ঘুরে ফিরে প্রায়ই একই। তাই এক্ষেত্রে একটু সাবধানতার সঙ্গে আবেদন ফরম পূরণ করলে তেমন জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে না। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের স্ক্যানকপি আপলোডসহ যাবতীয় তথ্য প্রদান করলেই আবেদন সম্পন্ন হয়ে যাবে। এখানে কোনো রকম টাকাপয়সা খরচ হবে না, বরঞ্চ সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয় আবেদনপত্র পেয়ে যাবে। এমনকি কৃতকার্য হলে অফার-লেটারটিও খুব কম সময়েই শিক্ষার্থীর ইমেইলে চলে আসবে।

পঞ্চম ধাপ: ভিসার জন্য আবেদন

বাংলাদেশের জার্মান এম্বেসির বর্তমান অবস্থা বেশ নাজুক। এপায়নমেন্টের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করলে ইন্টারভিউয়ের ডাক পেতে পেতে ১০ থেকে ১২ মাস লেগে যাচ্ছে। এই বিড়ম্বনাটি শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পুরনের সকল প্রচেষ্টা এক নিমেষেই ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারে। তাই এই সময় হিসাব করে অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজগুলো করার মুহুর্তে আগে ভাগেই রেজিষ্টেশন করে রাখা ভালো। যারা ২০২৩-এর উইন্টার সেশনটা ধরতে চান তাদের জন্য সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে বছরের শুরুতে তথা জানুয়ারিতেই এপায়নমেন্টের রেজিষ্টেশন করে রাখা। তাহলে অক্টোবর থেকে নভেম্বর নাগাদ ভিসা ইন্টারভিউয়ের ডেট পাওয়া যেতে পারে।

জার্মান এম্ব্যাসী থেকে ইন্টার্ভিউ ডেট দেওয়ার পূর্বে যাবতীয় কাগজপত্রের সফট-কপি চেয়ে শিক্ষার্থীকে ইমেইল করা হবে। এর ৭ দিনের মধ্যে ঐ মেইলের রিপ্লাইয়ে সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দিতে হবে। দরকারি কাগজপত্রগুলো হলো-

→ ইনরোলমেন্ট সনদ

→ আবেদনকারির সম্প্রতি তোলা বায়োমেট্রিক্যাল পাসপোর্ট সাইজ ছবির ৩ কপি (৩ টি ছবি এক পেজে নিয়ে পিডিএফ করে পাঠানো যেতে পারে)

→ শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর সহ সম্পূর্ণ ভাবে পূরণকৃত ভিসা আবেদন ফর্ম

→ পাসপোর্ট

→ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তির অফার লেটার

→ স্নাতকসহ বিগত সকল একাডেমিক ডিগ্রীর সনদ ও ট্রান্সক্রিপ্ট

→ আইইএলটিএস সনদ

→ ব্লক্ড অ্যাকাউন্টের প্রমাণপত্র

→ ৬ মাসের ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স

→ মোটিভেশন লেটার

→ সম্মতির ঘোষণাপত্র

সবগুলো স্ক্যান করা ফাইলকে একসঙ্গে করে একটি ১০ মেগাবাইটের পিডিএফ ফাইল বানিয়ে মেইল করতে হবে। ভাগ্য ভালো থাকলে কাগজপত্র ইমেইলের সাথে সাথেই ঐ দিনই ইমেইল অথবা ফোন করে ইন্টারভিউয়ের ডেট জানিয়ে দিতে পারে।

অতঃপর ভিসা ইনটারভিউয়ের ডেট পাওয়ার পর ইমেইল করা প্রতিটি কাগজপত্রের মুল কপি সঙ্গে নিয়ে এম্ব্যাসিতে যেতে হবে। অনলাইন সফ্ট কপিগুলোর ২ সেট সাদাকালো ভাল মানের অফসেট কাগজে প্রিন্ট করে নিয়ে যেতে হবে।

সাধারণত ইন্টারভিউয়ের দিন থেকে ২৫ কর্মদিবসের মধ্যেই ভিসা দিয়ে দেয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমবেশি হতে পারে। পাসপোর্ট সংগ্রহের ইমেইল পাওয়ার পর ভিসা ইন্টারভিউয়ের সময়ে যে কাগজ দিয়েছিল, সেটা নিয়ে এম্ব্যাসিতে গেলেই ভিসা হাতে পাওয়া যাবে।

ব্যবহারিক জ্ঞান ও গবেষণাধর্মী কাজে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যেই জার্মানিতে বিনামূল্যে স্নাতকোত্তর পড়ার এই উদ্যোগ। অন্যান্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ন্যায় বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি গত কয়েক বছর ধরে সফলতার সঙ্গে পড়াশোনা করছেন জার্মানিতে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে গুরুত্ব পাচ্ছে জার্মান ভাষা শিক্ষার। এরই ধারাবাহিকতায় ইংরেজির মত জার্মান ভাষারও শিক্ষা ও চর্চার জন্য সৃষ্টি হয়েছে অনেক সুযোগ। তবে ভিন্ন সংস্কৃতির এই দেশটিতে পড়তে যাওয়ার জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দরকার সেটি হচ্ছে ধৈর্য্য। জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য হলেও পদে পদে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। বিশেষ করে জার্মানির পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদনের মুহুর্ত থেকেই পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।

সূত্রঃ DTB

Leave a Comment