বদলে যাওয়া লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট

বদলে যাওয়া লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট

SA-23K 342

শরতের এক দুপুরে আমরা হাজির হয়েছিলাম রাজধানীর হাজারীবাগে। খাঁ খাঁ রোদ আর কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যেও আমাদের দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল গগনশিরীষগাছের সারি। যেন সবুজের দেয়াল। ভেতরে সাজানো বাগান। বাগানে সাদা জবা, নীল অপরাজিতা, অলকানন্দা। আর ঝকঝকে তকতকে, পরিপাটি এক ভবন। সবুজ খেলার মাঠটা দেখেও থমকে দাঁড়াতে হয়। এই সব মিলিয়েই লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট। যে এলাকায় আগে চামড়ার উটকো গন্ধে টেকা দায় ছিল, ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরিত হওয়ায় এখন সে অবস্থা আর নেই। নেই ময়লার স্তূপ। এলাকার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইনস্টিটিউটটিও সেজেছে নতুন করে। পরিবেশ বদলেছে, তাই পড়াশোনার ক্ষেত্রেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন।

প্রাণবন্ত, গোছানো ক্যাম্পাস

ব্যবহারিক ক্লাস শেষে গল্প করতে করতে বেরোচ্ছিলেন দুই বন্ধু—বিকাশ কর্মকার ও বিরাজকুমার রায়। তাঁদের হাতে চামড়ার ব্যবহারিকের উপকরণ। দুজনই লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাস প্রসঙ্গে কথা বলতেই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বিকাশ বললেন, ‘এই সুন্দর মাঠ, গোছানো ক্যাম্পাস কিন্তু দুই বছর আগেও ছিল না। এখানে-সেখানে আবর্জনা, নির্মাণ সরঞ্জাম দিয়ে ভরা ছিল। আমাদের ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান স্যার আসার পর ক্যাম্পাসের সব আবর্জনা সরিয়েছেন। মাঠ পরিষ্কার করে খেলার উপযোগী করেছেন। ফুলের গাছও লাগিয়েছেন।’ বিরাজকুমার যোগ করলেন, ‘এখানে ভর্তি হওয়ার পর সেশনজট নিয়ে কিছুটা হতাশা ছিল। এ ছাড়া করোনার পর চামড়াশিল্প ধাক্কা খাওয়ায় কাজের সুযোগ নিয়েও সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। সেশনজট নেই। স্নাতক শেষে হওয়ার আগেই অনেকে চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন।’

ইনস্টিটিউটের ভেতরে একটা বড় গাছ। শিক্ষার্থীরা বলেন বিন্নিগাছ। গাছের নিচে বাঁধানো সিমেন্টের গোলক ঘিরে জম্পেশ আড্ডা চলতেই থাকে। এই ইনস্টিটিউটের ফুটওয়্যার বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তাসনিমা আক্তার বলছিলেন, ‘আমাদের তো কলা ভবনের মতো বটতলা নেই। আমাদের আছে বিন্নিতলা। এখানেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা চলে। সময় কোন দিক দিয়ে চলে যায়, টেরই পাই না। দুটি বাসে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতেও পারি।’

প্রাতিষ্ঠানিক পড়া ও ব্যবহারিকের সমন্বয়

থিওরি ক্লাস থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীরা চলে যাচ্ছিলেন ব্যবহারিক ক্লাসে। এই ফাঁকে ফুটওয়্যার বিভাগের শিক্ষার্থী আলমগীর হোসেনের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, ‘৩০ বছরের পুরোনো সিলেবাস গত বছরে বদলেছে। এ ছাড়া সেমিস্টার সিস্টেম চালু হয়েছে, যা উচ্চশিক্ষার সহযোগী।’

প্রথমে ড্রয়িং খাতায় জুতা আঁকার পর কাঁচি দিয়ে কেটে যন্ত্রে বসানোর কাজ করছিলেন একদল শিক্ষার্থী। সঙ্গে শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষার্থী। ক্লাসের পড়াগুলো এখানে এসে হাতে-কলমে কাজে লাগানোর সুযোগ পান তাঁরা। একটি চামড়ার পণ্য একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রক্রিয়া ও প্রস্তুতকরণের পুরো ব্যবস্থাই এখানে আছে। ব্যবহারিক জ্ঞান আছে বলেই এখানকার শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরি পাওয়া সহজ।

একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী আফিয়া আঞ্জুম বললেন, ‘এখানে ল্যাবের যন্ত্রগুলো আগে ঠিকমতো কাজ করত না। এখন প্রায় সব কটিই সচল। অনেক যন্ত্র থাকার কারণে আমাদের কাজের জন্য বসে থাকতে হচ্ছে না। শিক্ষকেরা খুব আন্তরিক।

লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক সাইদুর রহমানের সঙ্গে আলাপ করেও আফিয়ার কথার প্রমাণ মিলল। বলছিলেন, ‘আমি এখানেই পড়ালেখা করেছি। আবার এখানেই শিক্ষকতা করছি। এটা দারুণ ব্যাপার। আমরা যেসব সমস্যায় পড়েছি, এখন আর তা নেই। আমাদের সময়ে সেশনজট, দক্ষ প্রশাসক, প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও উচ্চতর গবেষণা প্রকল্পের অভাব, নষ্ট যন্ত্রপাতিসহ অনেক সমস্যা ছিল। মাস্টার্স না থাকায় অনেকে হতাশ ছিল। এখন এসব সমস্যা নেই। তিন বিষয়ে মাস্টার্স চালু হয়েছে গত বছর থেকে।’

একমাত্র বিদেশি শিক্ষার্থী

রেমন্ড ওহিং শিকুকু। তিনি এসেছেন কেনিয়া থেকে। লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে মাস্টার্স করছেন। রেমন্ড বলেন, ‘আমি রানি এলিজাবেথ কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে এখানে এসেছি। চামড়া বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম আছে। এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েই পড়তে এসেছি। এখানে ব্যবহারিক ক্লাসের সুযোগ খুব ভালো। কেউ আমাকে লেদার বিষয়ে পড়ালেখার কথা জিজ্ঞেস করলে আমি এই প্রতিষ্ঠানে আসার পরামর্শ দিই।’

ক্লাবে ক্লাবে খেলাধুলা, বিতর্ক আর স্বেচ্ছাসেবী হওয়ার দীক্ষা

লেদার ইনস্টিটিউটের সবুজ মাঠটি কোনো দিনই ফাঁকা পড়ে থাকে না। প্রতিদিনই কোনো না কোনো খেলা চলে। ফুটবল–ক্রিকেট তো আছেই, সঙ্গে ব্যাডমিন্টন ও ভলিবলের মতো মৌসুমি খেলাও জমে। ফুটওয়্যার বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মোস্তাকিম বললেন, ‘নিজেদের বিভাগের মধ্যে প্রতিযোগিতার বাইরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগের সঙ্গে আমাদের খেলা হয়।’ মোহাইমিন আলম এই প্রতিষ্ঠানের রক্তদাতা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বাঁধনের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষার্থী বা তাঁদের পরিবারের কারও রক্ত লাগলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তাঁরা। ক্লাবের সদস্যসংখ্যা ২৫।

এ ছাড়া আছে ডিবেটিং ক্লাব। এই ক্লাবের সদস্য মোস্তাকিম জানালেন, তাঁরা নিয়মিত বিতর্ক চর্চা করেন। তাঁদের দলে আছেন অর্ধশতাধিক সদস্য। প্রথম আলো বন্ধুসভার একটি শাখাও এখানে আছে। এই সংগঠনের সভাপতি আবদুল্লাহ শিহাব বলছিলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা, ভ্রমণ ও স্বেচ্ছাসেবী নানা কাজে আমরা নিয়মিত অংশ নিই।’

পরিচালকের কথা

লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বললেন, তিনি এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পান ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে। এখানে এসে প্রথমেই তিনি পরিপাটি ক্যাম্পাস করার দিকে নজর দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বিশেষ অনুরোধ করে তহবিল সংগ্রহ করেন। এরপর এই প্রতিষ্ঠান থেকে যত আবর্জনা ও ময়লা আছে অপসারণ করেন। তিনি বলছিলেন, ‘২০ বছর আগের সিমেন্টের রাবিশ, চামড়ার উচ্ছিষ্ট দিয়ে চারপাশ ভর্তি ছিল। আমি প্রায় ১৫ ট্রাক ময়লা–আবর্জনা অপসারণ করেছি। ভবনের মোজাইকে ছিল ধুলার আস্তরণ। প্রায় তিন মাস কাজ করে ঝকঝকে করা হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের টয়লেট সংস্কার করে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। তিন বিভাগেই মাস্টার্স চালু করার পাশাপাশি এ বছর থেকে এমফিল ও পিএইচডি চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যত ধরনের ব্যবহারিক যন্ত্রপাতি আছে, সব ঠিক করা হয়েছে। প্রতি মাসে একটি করে চাকরির মেলা করা হচ্ছে।’ চাকরির মেলায় প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী চাকরি পাচ্ছেন বলে জানান তিনি। লেদার বিষয়ে বিদেশি ১০ জন বক্তা এনে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছেন তিনি।

এক নজরে

কলেজ অব লেদার টেকনোলজিকে ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ন্তভুক্ত করে ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি করা হয়। এ ইনস্টিটিউটের ৫টি ব্যাচে বর্তমানে ৭২৯ জন শিক্ষার্থী ও ৩২ জন পূর্ণকালীন শিক্ষক আছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত প্রকল্প ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক গ্রোথ প্রোগ্রাম’-এর আওতায় লেদার সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির ফিজিক্যাল ও কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্মত করার লক্ষ্যে কাজ চলছে।

সূএ :  প্রথম আলো     

Leave a Comment