বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ যেভাবে উন্নতি করতে পারে

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ যেভাবে উন্নতি করতে পারে

NT-22K 173

ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে নাজুক অবস্থান একটি প্রশ্ন সামনে আনছে যে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রদানের ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬০টিরও বেশি। তবে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পড়ালেখার মান, গবেষণা ও সহকার্যক্রমে পিছিয়ে রয়েছে। বিগত কয়েক বছরে বিশ্বসেরা র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তেমন একটা সম্মানজনক অবস্থানে আসতে পারেনি। যা দেশের শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মর্মাহত করেছে।

গত ৮ জুন যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) বিশ্বসেরা র‌্যাঙ্কিংয়ে ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তবে ৫০০ এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ৯টি ও পাকিস্তানের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছিল। গত পাঁচ বছরে এই র‌্যাঙ্কিংয়ের ৫০০ তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করতে পারেনি।

এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির বিষয়ে জোর দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। গত ২২ আগস্ট একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুণগতমান ও বিশ্বমানের গবেষণার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে আসতে সাহায্য করবে এমন শিক্ষাকার্যক্রমগুলো বাড়াতে হবে।”  বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংকে গুরুত্ব দেওয়ার জোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

তবে, আশার বিষয় দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমাগত উন্নতি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক র‍্যাঙ্কিং (এআরডাব্লিউইউ), টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই), এবং কোয়াক্যাকোয়ারেলি সাইমন্ডস (কিউএস) সহ বিভিন্ন বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং এজেন্সির তালিকায় ধাপে ধাপে ওপরের দিকে অবস্থান অগ্রসর হচ্ছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

দেশে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সরকার প্রতি বছর নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিচ্ছে। ফলে একইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যার চেয়ে গুণগতমানের বিষয়টি আলোচনায় চলে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মাধ্যমে শিক্ষার উন্নতিতে সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করছে। তবে দৃশ্যত শিক্ষারমান উন্নত হয়নি। ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে নাজুক অবস্থান একটি প্রশ্ন সামনে আনছে যে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রদানের ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? বা তাদের কার্যক্রম কী?

বিভিন্ন র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান

সর্বশেষ কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে আগের বছরের চেয়ে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিভাগে ১৬২ ধাপ উন্নতি করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) বিশ্বে ১৮৫তম স্থানে রয়েছে। যা তার আগের বছরে ছিল ৩৪৭তম। ঢাবি সামাজিক বিজ্ঞান এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগে ২০৩তম স্থান অর্জন করেছে।

অন্যদিকে, মাদ্রিদ-ভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান “ওয়েবমেট্রিক্স” এর তালিকায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট) দ্বিতীয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।

তবে আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১,৪৬৮তম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১,৪৭৬তম এবং বুয়েট ১,৪৮৩ স্থানে রয়েছে।

অন্যদিকে, ২০২১ সালে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি উইথ রিয়েল ইমপ্যাক্ট (ডব্লিউইউআরআই) র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ উদ্ভাবনী বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) স্থান পেয়েছে। এছাড়া একই বছরে টাইমস হায়ার এডুকেশনের (টিএইচই) ইমপ্যাক্ট র‍্যাঙ্কিংয়ে ৯৮টি দেশের এক হাজার ১১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫২.২ (১০০ এর মধ্যে) স্কোর নিয়ে ৬০০-৮০০ এর মধ্যে রয়েছে।

তবে “এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং ২০২২”-এ এশিয়ার শীর্ষ ২৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৫১-৩০০ এর মধ্যে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৩৫১-৪০০ এর মধ্যে এবং বুয়েট ৪০১-৫০০ এর মধ্যে রয়েছে।

মূল্যায়নের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান

কিউএস ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং করা হয় ৬টি মূল বিষয়ের মূল্যায়নের ভিত্তিতে। এগুলো হলো- অ্যাকাডেমিক খ্যাতি (৪০%), চাকরির বাজারে সুনাম (১০%), শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত (২০%), শিক্ষকপ্রতি গবেষণ মানপত্র (২০%), আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত (৫%), আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক ও কর্মসংস্থান অনুপাত (৫%)।

শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনের মতে, এসব সূচকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পিছিয়ে রয়েছে। যেমন, বৈশ্বিক মান হিসেবে প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক থাকা দরকার। তবে, সর্বশেষ ইউজিসি”র প্রতিবেদনে দেখা যায় দেশের ৫৭টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মান রক্ষা করা হয়নি।

এই অনুপাতে- ঢাবিতে ১৬ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক, বুয়েটে ১৪ জন ছাত্রের জন্য, বাকৃবিতে ৭ জন ছাত্রের জন্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ জন ছাত্রের জন্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক এবং জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি ২২ ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন।

এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেছেন, “বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতার পরিবর্তে ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হয়। ফলে কম যোগ্য প্রার্থীরা নিয়োগ পান। এতে করে শিক্ষারমানও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।”

আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত

আন্তর্জাতিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ের পূর্বশর্ত। এছাড়া বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত কয়েক বছরে খুব একটা বাড়েনি। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২১০ জন, ২০১২ সালে ৫২৫ জন, ২০১৩ সালে ৩২৬ জন, ২০১৪ সালে ৪৩২ জন, ২০১৫ সালে ৫৯৩ জন, ২০১৬ সালে ৩৫৫ জন, ২০১৭ সালে ৪৬১ জন, ২০১৮ সালে ৮০৪ জন, ২০১৯ সালে ৪৮২ জন, ২০২০ সালে ৭৬৭ জন জন ছাত্র রয়েছে।

বিদেশি শিক্ষার্থী কম হওয়ার কারণ হিসেবে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, গতানুগতিক পাঠ্যক্রম, অবকাঠামোগত সমস্যা, বাসস্থান সংকট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির কারণে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে তিনি ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের বেতন কাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে আগ্রহী নয়। আবার যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদেশি শিক্ষকদের জন্য উচ্চ বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দিতে চান তাহলে সেটিও একধরনের  বৈষম্য তৈরি করবে।”

শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক শেখ একরামুল কবির বলেন, “কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি প্রথম দশ বা ১০০ জনের মধ্যে একটি অবস্থান নিশ্চিত করতে চায় তবে তাকে অবশ্যই শিক্ষার্থী ভর্তির পদ্ধতি, শিক্ষক নিয়োগ এবং পদোন্নতিসহ বেশকিছু নিয়মনীতি সংস্কার করতে হবে। আবাসিক সুবিধা, গবেষণা বরাদ্দ, শিক্ষণ পদ্ধতি এবং পাঠ্যক্রমে বদল আনতে হবে অন্যথায় কোনো লক্ষ্য অর্জন সম্ভব না।”

সূত্রঃ dhakatribune

Leave a Comment