শিক্ষা ছুটিতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দিতে হবে অগ্রিম পদত্যাগপত্র, সময়মতো না ফিরলে থাকবে না চাকরি

শিক্ষা ছুটিতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দিতে হবে অগ্রিম পদত্যাগপত্র, সময়মতো না ফিরলে থাকবে না চাকরি

NT-22K 589

শিক্ষা ছুটির পর কোনো শিক্ষক নির্ধারিত না ফিরলে শূন্য পদে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতমূলক করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।  নির্ধারিত ছুটির অতিরক্তি সময় বিদেশে থাকার প্রবণতা কমাতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউজিসি। শিক্ষা ছুটির পর যদি কোনো শিক্ষক সময়মতো ফিরে না আসেন, তাহলে তার অগ্রিম জমা দেওয়া পদত্যাগপত্র কার্যকর হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় শূন্য পদের জন্য নতুন শিক্ষক নিয়োগ করতে পারবে। এমন বিধান রেখে শিক্ষকদের জন্য শ্রেণিপাঠে এবং গবেষণায় সময় নির্ধারণ করে “পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচিং লোড ক্যালকুলেশন নীতিমালা-২০২২” প্রণয়ন করেছে ইউজিসি। যা অতি সম্প্রতি কার্যকর হয়েছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বিদেশে ছুটি ভোগ করেও দায়িত্বে ফিরছেন না বলে কমিশন এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব শিক্ষকরা সরকারি বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করলেও তাদের অনুপস্থিতির কারণে বিভাগগুলোকে শিক্ষক ঘাটতির সম্মুখীন হতে হয়। বর্তমানে একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন এবং অন্যান্য ভাতাসহ উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটি পেয়ে থাকেন। ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “ সরকারি সুবিধার অপব্যবহার এবং শিক্ষক স্বল্পতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগ যাতে একাডেমিক ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেজন্য শিগগিরই সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নীতিমালা পাঠানো হবে।” তিনি বলেন, “প্রতিবছর আমরা শিক্ষকদের ছুটি শেষে ক্লাসে না ফেরার অভিযোগ পাই। তাদের অনুপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত করে।”

অনুপস্থিতির সংখ্যা অনেক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের সহকারী অধ্যাপক জাবের সিদ্দিকী  ২০০১ সালের ১৮ আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত অবৈতনিক ছুটিতে বিদেশে যান। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেন। এক বছর বিনা বেতনে বিদেশে থাকার পর ছুটি বাড়ানোর আবেদন করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়নের শিক্ষক অধ্যাপক শামসুল আলম।

ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এই শিক্ষকদের কেউই কর্মস্থলে ফিরে আসেননি। পরে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের চাকরিচ্যুত করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বকেয়া পরিশোধের নির্দেশ দেয়। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষকদের এরকম অনুপস্থিতির কারণে একইরকম সমস্যার মুখোমুখি হয়।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষক- পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ মিজানুর রহমান, মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাহিদ শাহ, আইসিটির সহকারী অধ্যাপক খন্দকার ফিদা হাসান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল বাসার, ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসনিমা আক্তার এবং সহকারী অধ্যাপক ড. নৃবিজ্ঞান হামিদা আক্তার – বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে বিদেশ গেলেও আর ফিরে আসেননি।

ইউজিসি’র সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১,৬৮৫ জন শিক্ষক শিক্ষা ছুটি নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ২৭২ জন ফিরে আসেননি, এদের মধ্যে ১২৫ জনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ২০২০ সালে ৪৩ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩,৫১১ জন শিক্ষক বিভিন্ন ছুটিতে যান, যার মধ্যে ২,০৮৮ জন শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে ছিলেন। ২০১৯ সালে মোট ২,২৬৪ জন এবং ২০১৮ সালে ২,১৩৩ জন শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে গিয়েছিলেন। ২০২০ সালে, ৮০ জন শিক্ষক লিয়েন ছুটিতে অন্যান্য সংস্থায় জড়িত ছিলেন, ২০৩ জন বিনা বেতনে ছুটিতে ছিলেন এবং ৪৩ জন ছুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও অবৈধভাবে বিদেশে অবস্থান করছেন।

এদিকে, ২০১৯ সালে ১৫ জন, ২০১৮ সালে ৭০ জন এবং ২০১৭ সালে ২৫ জন শিক্ষক অবৈধভাবে বিদেশে অবস্থান করছেন। এ সময়ে প্রায় ১,২০১ জন শিক্ষক খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন।

সংকট বড় আকার ধারণ করছে

বিদ্যমান আইনে শিক্ষকরা বেতন ও অবৈতনিক ছুটিতে সর্বোচ্চ চার বছর পর্যন্ত বিদেশে ছুটিতে থাকতে পারেন। শিক্ষকদের ডিগ্রি বা গবেষণা সময়মতো শেষ না হলে অবৈতনিক ছুটি হিসেবে তাদের ছুটি দুই বছর বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়। তবে চার বছর ছুটির পর তাদের ফিরে আসা বাধ্যতামূলক এবং ফিরে এসে দুই বছরের জন্য ছুটি বাড়ানোর আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া কেউ যদি চার বছর বা ছয় বছর ছুটির পর পদত্যাগ করতে চান, তাহলে তাকে ছুটির সময় নেওয়া টাকা ফেরত দিতে হবে, অথবা সমপরিমাণ মেয়াদে চাকরি করার পর পদত্যাগ করতে হবে। তবে শিক্ষকদের একটি অংশ দীর্ঘসময় ধরে অনুপস্থিত রয়েছেন এবং ছুটির সুযোগের অপব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমকে প্রভাবিত করছেন বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম ৩০০ নম্বরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বৃত্তি পেতে পারে এমন শিক্ষকদের জন্য তিন বছরের তহবিল চালু করতে যাচ্ছে ইউজিসি। এই সুযোগটি পেতে একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে তাদের অগ্রিম পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে এবং চার বছর পরে ফিরে না এলে সেই অর্থ ফেরত দিতে হবে। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “শিক্ষকদের একটি অংশ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়ার জন্য জনগণের অর্থ ব্যয় করলেও সেখানে ভালো সুযোগ পাওয়ায় তারা উচ্চশিক্ষা শেষ করার পর আর ফিরে আসেন না।”

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “শিক্ষকদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, পুরো শিক্ষা খাতের জন্যই দুর্ভোগের কারণ।” তারা দুজনেই শিক্ষকদের ফিরে না আসার কারণ চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন।

সূত্রঃ dhakatribune

Leave a Comment