নামে শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

নামে শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

SA-23K 359

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়ের ছড়াছড়ি। পড়ানো হয় ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি। ইউজিসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

 

নামে শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বিশেষায়িত দক্ষ স্নাতক ডিগ্রিধারী তৈরির চিন্তা থেকেই দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক, সমাজবিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো বিষয় পড়ানো হচ্ছে। বাদ পড়ছে না কৃষি বিষয়ও। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধেকের মতো শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়ের। এই প্রবণতা বাড়ছেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে সব বিষয় পড়াতে চাইলে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য সফল হবে না। নিজেদের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে বুয়েট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কয়েকটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় দেশে-বিদেশে সুনাম অর্জন করছে।

যেনতেনভাবে বিভাগ খোলার জন্য অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ভূমিকাকে দায়ী করছেন। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ খোলার অনুমোদন দিয়ে থাকে এই প্রতিষ্ঠান। ইউজিসির হাত ধরেই এসব বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেতাইভাবে বিভাগ খোলা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা থাকা দরকার বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা।

তবে ইউজিসির বর্তমান দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এই দায় নিতে চান না। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (সদস্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) দিল আফরোজা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি বিভাগও খুলতে দিইনি। পূর্বসূরিরা খোলার অনুমতি দিলে আমি কীভাবে দায়দায়িত্ব নেব? আমি মনে করি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কোনোভাবে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত নয়।

প্রবণতা বেশি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে

বর্তমানে দেশে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে ১৩টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো হলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিরোজপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। চাঁদপুর, সুনামগঞ্জ ও পিরোজপুরের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় একেবারেই নতুন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ৫৭ হাজারের বেশি।

এ ধরনের বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুন্নয়ন বাজেট ছিল ৬৬৭ কোটি ৭৮ লাখ (নিজস্ব আয়) টাকা।

খোঁজ নিয়ে ও ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন ঘেঁটে জানা গেছে, ২০১৮ সালে জামালপুরে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি অনুষদের অধীনে ছয়টি বিভাগ আছে। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বাইরে দুটি অনুষদ আছে। যাত্রা শুরুর সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি বিভাগের দুটিই ছিল বিজ্ঞানের বাইরের। একটি হলো ব্যবস্থাপনা, আরেকটি সমাজকর্ম বিভাগ।

গোপালগঞ্জে ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই ইতিহাস বিভাগ খোলা হয়। ইউজিসি আপত্তি তুললে আন্দোলন শুরু হয়। পরে বাধ্য হয়ে ইউজিসি অনুমোদন দেয়।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে ৩৪টি বিভাগ রয়েছে, যার মধ্যে ২০টি বিজ্ঞান, প্রকৌশল, লাইফ সায়েন্স ও কৃষি অনুষদভুক্ত। বাকি ১৪টি বিভাগ কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও আইন অনুষদভুক্ত। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অধ্যাপক আছেন মাত্র তিনজন। একজন আবার চুক্তিতে।

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি অনুষদের একটি ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি অনুষদের দুটি বিজ্ঞানের বাইরের। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যবসায় শিক্ষা, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ রয়েছে।

আগে থেকেই এভাবে চলছে

দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি অনুষদের অধীনে ২৭টি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বাইরে কলা ও মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ রয়েছে। এখানে কেবল সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলোতে শিক্ষার্থী ২ হাজার ৬০০-এর বেশি। অথচ বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলোর শিক্ষার্থী প্রায় ১ হাজার ৯০০। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট শিক্ষার্থী ৮ হাজারের বেশি।

কৃষিশিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিজের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারেনি। নয়টি অনুষদের মধ্যে কৃষি ও বিজ্ঞানের বাইরে দুটি অনুষদ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ব্যবস্থাপনা, মার্কেটিং, হিসাববিজ্ঞান, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিষয়ও পড়ানো হয়। মোট বিভাগ আছে ৪৫টি।

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের অধীন ১৯টি বিভাগ রয়েছে। ছয়টি অনুষদের তিনটিই বিজ্ঞানের বাইরের।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের অধীনে ছয়টি বিভাগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট বিভাগ ৫৮টি।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়েন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের অধীনে ৩০টি বিভাগের মধ্যে ১০টি বিজ্ঞানের বাইরে।

এত বিভাগ কেন

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বনিম্ন ২টি থেকে সর্বোচ্চ ৮৩টি বিভাগ রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস, বাংলা, সমাজকর্ম, সমাজবিজ্ঞান, ইংরেজির মতো বিভাগ কেন থাকবে—এই প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ আছে, এত বিভাগ খোলার পেছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে, শিক্ষক ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ। আবার উপাচার্যরা মনে করেন, বেশি বিভাগ থাকলে তাঁদের গুরুত্ব বাড়ে।

ইউজিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, এভাবে বিভাগ খোলার মাধ্যমে ইউজিসিরও কোনো কোনো কর্মকর্তার স্বার্থ থাকে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও শিক্ষাপ্রশাসন কর্মকর্মাদেরও স্বার্থ জড়িত। এসব ব্যক্তির কারও কারও আত্মীয়স্বজন নিয়োগও হয় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে।

উচ্চশিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কারিগরি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ ডিগ্রিধারী বের হলে দেশের লাভ হতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান বাস্তবতায় বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত এত বিভাগের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। এর উত্তর হতে পারে, দরকার নেই।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান’ করার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আগে থেকে যেসব বিষয় চালু আছে, তার সবই এখন প্রাসঙ্গিক কি না, সেটিও দেখার বিষয়।

কারা উপাচার্য হচ্ছেন

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক যোগ্যতার কথা বলা আছে। যেমন নোয়াখালীর ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কাউকে উপাচার্য নিয়োগের কথা বলা আছে। তবে এখানে অতীতে শিক্ষা ও গবেষণার (আইইআর) শিক্ষককে উপাচার্য করার নজির রয়েছে। সর্বশেষ রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পিরোজপুরে দেওয়া হয়েছে মনোবিজ্ঞানের এক অধ্যাপককে।

আবার শাহজালালে সুনির্দিষ্ট কোনো যোগ্যতার কথা বলা নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অর্থনীতির একজন শিক্ষক উপাচার্যের দায়িত্বে আছেন।

বুয়েটের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষায়িত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাঁদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের অনেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষক নন।

নামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু উপাচার্য হলেন মানবিক বিষয়ের। এগুলোকে সরকার সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে কি না, সেটাও প্রশ্ন।

নামের প্রতি অবিচার

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর মনে করেন, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে নামের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। সব বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটাতে চাইলে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় করার কী দরকার?

বুয়েটের সাবেক শিক্ষক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসটিংগুইশড অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয় খোলা যাবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। নইলে এভাবে চলতেই থাকবে।

সূএ :  প্রথম আলো     

Leave a Comment